দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য উপযোগী নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গতকাল রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি’র উদ্যোগে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে হিন্দু সমপ্রদায়ের সদস্যদের সম্মানে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য তিনি এ মন্তব্য করেন।
জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন উল্লেখ করে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমরা জানি বিশ্বের অনেক দেশেই হয়তো নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি রয়েছে। তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য এখনো উপযোগী নয় বলেই আমরা কম বেশি মনে করি। কাকে কিংবা কোন ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠানো হচ্ছে, অবশ্যই জনগণের সেটি জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত যে পিআর পদ্ধতি, এই পদ্ধতিতে কোন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা হচ্ছে, জনগণের সেটি জানার পরিষ্কার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি বা যেকোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি জাতীয় সংসদে কিংবা সরকারে প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে অবশ্যই তাদের জনগণের মুখোমুখি হয়ে, জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে জনগণের রায় অর্জন করা জরুরি।
তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতি এবং আরও দু’একটি ইস্যুতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা ভিন্ন মত রয়েছে। এই ধরনের ভিন্ন মত গণতান্ত্রিক বিশ্বে স্বীকৃত। এটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে বাস্তবতার নিরিখে প্রতিটি ইস্যুই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরভাবে সমাধান হয়ে যাবে বা সমাধান করা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি, ইনশাআল্লাহ। যারা আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করছেন, এর মাধ্যমে আপনারা হয়তো নিজেদের অজান্তেই গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছেন। একইসঙ্গে পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচার পুনর্বাসনের পথও হয়তো বা সুগম হচ্ছে।
তারেক রহমান বলেন, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের জনগণও কংশরূপী এক ফ্যাসিস্টের দুঃশাসন অত্যাচার ও নির্যাতন দেখেছে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে কংশরূপী ফ্যাসিস্টের কবল থেকে এই বাংলাদেশ এবং দেশের গণতান্ত্রিককামী মানুষ মুক্ত হয়েছে। এই স্বৈরাচারের পতনের পর দেশে এখন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার যাত্রা শুরু হয়েছে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ সংসদ এবং সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত গণতন্ত্র উত্তরণের যাত্রাপথ কিন্তু ঝুঁঁকিমুক্ত নয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করেছে। কিন্তু আমরা খেয়াল করে দেখছি, এই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বক্তব্য, মন্তব্য কিংবা নিত্যনতুন শর্ত বা শর্তের প্রস্তাবনা সামগ্রিকভাবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অবাধ, সুষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দেবার সুযোগ পেলে জনগণ বিএনপিকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে। এই ভয়ে পলাতক স্বৈরাচার বিএনপি’র বিজয় ঠেকাও-এর মতন অন্তর্ঘাতী অপরাজনীতি চালু করেছিল। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকেও গত ১৬-১৭ বছর ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেটি লোকাল ইলেকশন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনের প্রায় প্রত্যেকটি জায়গায় একই অবস্থা হয়েছিল। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশে এবার ক্ষমতাসীন সরকার নয় বরং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের রাজপথের সহযোদ্ধা কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর আচরণেও সেই পলাতক স্বৈরাচারের সরকারের মতন বিএনপি’র বিজয় ঠেকাও প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি’র বিজয় ঠেকানোর অপরাজনীতি করতে গিয়ে বিতাড়িত ফ্যাসিবাদ সরকার দেশকে একটি তাঁবেদারি রাষ্ট্রে একটি বিশাল বড় জেলখানায় পরিণত করেছিল।
তিনি বলেন, বর্তমানে ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশেও যারা মনে করছেন নির্বাচন দিলে জনগণ ভোট দিয়ে বিএনপিকে সরকার গঠনে সহায়তা করবে। যারা এই চিন্তা থেকে বিএনপি’র বিজয় ঠেকানোর জন্য নানা রকম অপকৌশলের বা শর্তের বেড়াজালের আশ্রয় নিচ্ছেন। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করুন। জনগণের শক্তির উপরে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখুন। বিএনপি’র বিজয় যদি জনগণ দিয়েই থাকে, সেই বিজয় ঠেকাতে গিয়ে জনগণের রায় প্রদানের পথ রুদ্ধ করবেন না।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যকার বিরোধ এমন পর্যায়ে নেয়া উচিত হবে না, যেই বিরোধকে পুঁজি করে পরাজিত ফ্যাসিবাদ নিজেদের অপকর্মগুলোকে জাস্টিফাই করার সুযোগ নিতে পারে। আমি মনে করি, প্রতিটি ইস্যুতে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য হতেই হবে। এটি এমন কোনো জরুরি নয়। তবে অবশ্যই, অবশ্যই পলাতক স্বৈরাচার বা যে পলাতক ফ্যাসিবাদ তাদের পুনর্বাসন ঠেকানো কিংবা দেশকে তাঁবেদার মুক্ত রাখার মতন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে অবশ্যই ঐকমত্য এবং ঐক্যবদ্ধ থাকা অত্যন্ত জরুরি।
হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি বিভিন্ন সময় দেশে যারা নিজেদেরকে সংখ্যালঘু সমপ্রদায় হিসেবে বিবেচনা করেন। সেই সমপ্রদায়ের ওপর কিংবা তাদের ধর্মীয় স্থাপনা অথবা বাসাবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাগুলোকে যদি আমরা পর্যালোচনা করে দেখি, তবে দেখবো দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ হামলার ঘটনা কোনো ধর্মীয় কারণে হয়নি; বরং আমরা দেখেছি, প্রতিটি ঘটনা নিবিড়ভাবে তদন্ত করলে দেখা যাবে অধিকাংশ হামলার ঘটনার নেপথ্য ছিল অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অথবা অবৈধ লোভ লাভের আশা। যে কারণেই হোক না কেন ঘটনাগুলো। কোনো কারণেই যাতে করে কারও ওপর কোনো হামলা কিংবা অবিচার না হয়, সেটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্র এবং সরকারের দায়িত্ব।
তারেক রহমান বলেন, এই বাংলাদেশ কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠী কিংবা দলের নয়। এই বাংলাদেশ আপনার, আমার, আপনাদের এবং আমাদের সবার- দলমত ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি, অবাঙালি, নৃতত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী কিংবা সংশয়বাদী, এই বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের একমাত্র গর্বিত পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক সকল ক্ষেত্রে, দেশের আইন অনুযায়ী সমান অধিকার ভোগ করবেন। এটি বিএনপি’র নীতি। এটি বিএনপি’র রাজনীতি।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকে একটা নতুন করে কথা উঠেছে ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশে এখানে এক ধরনের উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই উগ্রবাদকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়া যাবে না। যদি উঠে তাহলে আমাদের বাংলাদেশের যে আত্মা, সেই অস্তিত্ব আমাদের রক্ষা পাবে না, এই কথাটা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে।
বিএনপি’র ধর্মবিষয়ক সহসম্পাদক অমলেন্দু দাস অপুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বিজন কান্তি সরকার, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু, প্রান্তিক জনশক্তি উন্নয়ন বিষয়ক সহ-সম্পাদক অপর্ণা রায় দাস, নির্বাহী কমিটির সদস্য রনেশ দত্ত, দেবাশীষ রায় মধু, নিপুণ রায় চৌধুরী, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের তপন চন্দ্র মজুমদার, এসএন তরুণ দে, মিল্টন বৈদ্য, পূজা উদ্যাপন ফ্রন্টের জয়দেব জয়, হিন্দু মহাজোটের সুশান্ত চক্রবর্তী, ঢাকা মহানগর পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি জয়ন্ত দেব, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আপনার মতামত লিখুন :